সন্ত্রাসী সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) সম্প্রতি পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার উত্তরাঞ্চলের কৌশলগত চিত্রাল শহরে হামলা চালিয়েছে। এই হামলা একটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে, জঙ্গি গোষ্ঠীটি পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতর থেকে সাহায্য পাচ্ছে কিনা। পাকিস্তানে এটি একটি ক্রিটিক্যাল প্রশ্ন, যদিও মিডিয়াতে জিজ্ঞাসা করা হয় না
এটা বেশ স্পষ্ট যে, টিটিপি গোষ্ঠীর গ্রুপগুলো কোনো রাগঢাক না করেই চিত্রালে একাধিক হামলা চালিয়েছিল। যেটা আফগান তালেবান শাসনের সমর্থন ও অনুমোদন ছাড়া সম্ভব ছিল না। কয়েক দিন স্থায়ী হওয়া হামলা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য একটি স্পষ্ট আহ্বান ছিল। টিটিপি যে স্থানীয় উপজাতি, আধা-সামরিক বাহিনী এমনকি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সাহায্য পাচ্ছে- এমন সম্ভাবনা খুবই গুরুতর।
যে কারণে এমন একটি সম্ভাবনাকে হেলাফেলা করে উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় না। প্রথমত, চিত্রালে টিটিপির হামলার পরিকল্পনা করেছিল হক্কানি গোষ্ঠী, যাদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। হক্কানি নেটওয়ার্কের প্রধান সিরাজউদ্দিন হক্কানি এখন আফগানিস্তানে তালেবান শাসনামলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
হক্কানি ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত, যখন তালেবানরা আফগান বাহিনীর কাছ থেকে কাবুল দখল করেছিল, তখন সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। প্রকৃতপক্ষে, এটি জানা যায় যে, সাবেক আইএসআই প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ নতুন তালেবান সরকারে হক্কানিদের গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। সিরাজুদ্দিন হক্কানির বাবা জালালউদ্দিন হক্কানি ছিলেন আরেক অপরিচিত আইএসআই প্রধান হামিদ গুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যান মার্কিন অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন হক্কানিদেরকে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের একটি ‘সত্যিকারের হাত’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
হক্কানিরা এই অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলার মাস্টারমাইন্ডিংয়ে বিশেষজ্ঞ। তারা এত বছর আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন শক্তিশালী বাহিনী থেকে টিকে ছিল, মূলত সেটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনের জন্য সম্ভব হয়েছে। হক্কানিরা বিপজ্জনক খেলা থেকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকে রেখেছে- এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর (মার্কিন বাহিনী) বিরুদ্ধেও।
এর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। একটি হল তাদের ক্যাডারে পাকিস্তানিদের নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত। জঙ্গি নেটওয়ার্কের ১০ শতাংশেরও বেশি ক্যাডার পাকিস্তানি, যারা মূলত টিটিপি, লস্কর-ই-তৈয়্যেবা এবং লস্কর-ই-ঝাংভি থেকে আগত। এটি যে সেনাবাহিনী এবং এর গোয়েন্দা শাখা আইএসআই-এর সাথে তাদের সম্পর্কের গভীরতা নির্দেশ করে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরও কিছু ঘটনা জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সেনাবাহিনীর জড়িত হওয়ার আশঙ্কাকে জোরদার করে। ২০২২ সালের অক্টোবরে সোয়াতের টিটিপি জঙ্গিরা একটি স্কুল ভ্যানে গুলি চালায়। স্থানীয় জনগণ এই হামলার প্রতিবাদে জেগে উঠলে সেনাবাহিনী জঙ্গিদের খুঁজে বের না করে জনগণের কণ্ঠকে দমন করতে এগিয়ে আসে।
তবে ২০২১ সালের আগস্টে কাবুল বিজয়ের পর পরই তালেবান এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যায়। হক্কানিরা নতুন প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পেয়েছে, যার জন্য মূলত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধন্যবাদ পেতে পারে। কিন্তু টিটিপিকে সোয়াত এবং অন্যান্য উপজাতীয় এলাকায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে সেনাবাহিনীর আলোচনায় একটি বেদনাদায়ক পয়েন্ট হয়ে ওঠে। ২০২২ সালে ৯ এপ্রিল যখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সেনাবাহিনী কর্তৃক অনাকাঙ্খিতভাবে পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল, তখন জেনারেলদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান জনগণের ক্ষোভ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী তখন ভুল বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু ‘বন্ধুত্বপূর্ণ তালেবান’-এর কাছে এলাকা সমর্পণ করে বিদ্রোহের মুখোমুখি হতে কোনো জেনারেলের সাহস ছিল না।
সুপরিচিত ভাষ্যকার এবং পদার্থবিজ্ঞানী ড. পারভেজ হুদভয় লিখেছেন, ‘আমেরিকানরা চলে গেছে এবং ভারতকে আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তাহলে এখন কে বন্ধু না শত্রু? উপরের আদেশগুলো কি নিচের লোকেরা অনুসরণ করছে? অফিসার এবং সৈন্য কি একই জায়গায়?’
তবে তিনি (ড. পারভেজ হুদভয়) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা থেকে বিরত ছিলেন– সেটি হল ‘কেন একটি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী সেনাবাহিনী অপেক্ষাকৃত ছোট জঙ্গি গোষ্ঠীকে হটাতে ব্যর্থ হয়েছে?
Leave a Reply