দেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে। ১৯৯৮ সালের তুলনায় বায়ুদূষণ আরও বেড়েছে। গ্রামের তুলনায় শহরে দূষণ বেশি। ইটভাটা ও যানবাহন দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এ ছাড়া কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও কম দায়ী নয়।
বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। দূষিত বায়ুতে থাকার কারণে বছরে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছয় বছর আট মাস কমে যাচ্ছে। আবার দেশের মধ্যেও একেক এলাকার বায়ুর মান একেক রকম। সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হচ্ছে গাজীপুর। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকার সবচেয়ে কাছের ওই শিল্প এলাকার মানুষের গড় আয়ু আট বছর তিন মাস কমে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণবিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের কোন দেশের অধিবাসীদের গড় আয়ু কী পরিমাণে কমছে, সেই হিসাব ধরে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হচ্ছে, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড়পড়তা আয়ু দুই বছর চার মাস কমছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ১৯৯৮ সালের তুলনায় বায়ুদূষণ ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। এতে গড় আয়ু দুই বছর আট মাস কমেছে। তবে ২০২০ ও ২০২১ সালের তুলনায় ২ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে গত এক যুগে বিশ্বে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে চীন সবচেয়ে বেশি সাফল্য দেখিয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটি ঢাকা নগরের জন্য শুধু দুই ঘণ্টা পরপর বায়ুর মানবিষয়ক তথ্য দিয়ে থাকে। আর দেশের অন্যান্য বড় শহরের তথ্য আসে এক দিন পর। তাই অন্যান্য এলাকার বায়ুর মান তাৎক্ষণিক জানা যায় না। ফলে সেখানে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ কম। বিশ্বের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং উন্নত রাষ্ট্র অ্যাপসের মাধ্যমে বায়ুর মানের তথ্য দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে তা এখনো শুরুই হয়নি।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালসহ বিভিন্ন সংস্থা বায়ুর মানসংক্রান্ত তথ্য নিয়মিত বা সরাসরি দিয়ে থাকে। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের বায়ুর মানবিষয়ক তথ্য যথেষ্ট সময়োপযোগী ও নির্ভরযোগ্য নয়।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আগামী এক মাসের মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার বায়ুমানের তথ্য ওয়েবসাইটে তুলে দিতে পারব। আর এক বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতো সরাসরি বায়ুর মানের তথ্য অ্যাপসের মাধ্যমে তুলে ধরব।’
সবচেয়ে নির্মল বায়ুর সিলেটেও ১০ গুণ দূষণ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৪৮ লাখ মানুষ সারা বছর দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রা—প্রতি ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ একজন মানুষকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে কম অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম-২.৫ থাকতে হবে।
এমনকি বাংলাদেশ সরকারও নিজস্ব মানমাত্রা হিসাবে পিএম-২.৫ ঘনমিটারে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ১৫ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্মল বায়ুর জেলা সিলেটেও এর চেয়ে বেশি মাত্রায় বায়ুদূষণ থাকছে। ওই জেলায়ও ডব্লিউএইচওর মানমাত্রার চেয়ে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা প্রায় ১০ গুণ বেশি। আর বাংলাদেশের নিজস্ব মানমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।
প্রতিবেদনে বিশ্বে অন্য যেসব কারণে সামগ্রিকভাবে গড় আয়ু কমে, তার সঙ্গে বায়ুদূষণের তুলনা টানা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গড় আয়ু কমছে হৃদ্রোগ ও রক্তপ্রবাহের সমস্যার কারণে। এতে বাংলাদেশের একেক অধিবাসীর গড় আয়ু ছয় বছর আট মাস কমে যাচ্ছে। এরপরই রয়েছে বায়ুদূষণ। ধূমপানের কারণে কমছে দুই বছর এক মাস, শিশু ও মাতৃত্বকালীন অপুষ্টিজনিত সমস্যার কারণে কমছে এক বছর চার মাস আয়ু।
বাংলাদেশের বড় বড় শহরের বায়ুর মান গ্রামের তুলনায় বেশ খারাপ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরে ৭ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ বসবাস করে। এসব শহরের মানুষের গড় আয়ু সাত বছর ছয় মাস কমে যাচ্ছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করে বায়ুর মান ঠিক করা গেলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়তে পারে। ঢাকায় এভাবে গড় আয়ু আট বছর এক মাস বাড়ানো সম্ভব। আর চট্টগ্রামে তা বাড়তে পারে ৬ বছর ৯ মাস। আর সারা দেশের গড় আয়ু বাড়তে পারে পাঁচ বছর আট মাস।