রঞ্জু আহমেদ
ভারতের ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলগুলোতে সাম্প্রতিক বন্যা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। টানা চারদিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানির স্তর বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক ছিল। এই অঞ্চলে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে নদীগুলোর পানি বাড়ে, এটি একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু বন্যার কারণ একেবারেই আলাদা। এই ক্ষেত্রে বন্যা শুধু বৃষ্টির কারণে নয়, বরং দম্বুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দেওয়ার ফলে এই দুর্যোগ ঘটে। যা ছিল পুরোপুরি ইচ্ছাকৃত, মানুষের অবহেলার ফল।
দম্বুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উচ্চ পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত, যেখানে বৃষ্টির পানি দ্রুত সঞ্চিত হয়ে নিচের দিকে তীব্র চাপ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নিচের নদীগুলো, বিশেষ করে গোমতী এবং মুহুরী নদী, ইতিমধ্যেই টানা বৃষ্টির কারণে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। প্ল্যান্ট থেকে হঠাৎ করে পানি ছেড়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশকে আগে থেকে না জানানো ফলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়, যা জীবন ও সম্পদের ক্ষতি করে। এই অমানবিক কাজটি পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার মতো ছিল, যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে বিপর্যয়ে পরিণত করেছে।
বন্যার অতীতে বহুবার ঘটেছে, বন্যা মানবিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির একটি কঠোর স্মারক। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে বারবার বন্যা হয়েছে, ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, বহু প্রাণহানি ঘটেছে, এবং দেশের অবকাঠামো ও অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৮ সালের বন্যা, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বন্যা, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত করে, এতে ১০০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে, এবং ৩০ মিলিয়নের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বন্যা প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একইভাবে, ২০০৪ সালের বন্যা ৩৬ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে, ৮০০ জনের মৃত্যু ঘটে, এবং ৬.৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ আরেকটি বিধ্বংসী বন্যার শিকার হয়, যা ১১০০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এবং ১৪ মিলিয়ন মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে।
এই বন্যাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি প্রমাণ করে, বাংলাদেশে বারবার বন্যা দেশে আর্থিক ও অবকাঠামোগত চাপ সৃষ্টি করে। ২০১৭ সালের বন্যা, যা ৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, শত শত মানুষ নিহত হয় এবং ফসল, অবকাঠামো এবং বাড়িঘরের ক্ষেত্রে প্রায় ১.৭ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। এই বন্যাগুলির ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত ক্ষতি ঘটিয়েছে।
দম্বুর থেকে ফেনীর দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার, কিন্তু নদী পথে এই দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের বেশি। বন্যার পানি এতো দূরত্ব অতিক্রম করতে যে সময় নিত, সেটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় হতে পারত। বাংলাদেশের উচিত ছিল সেই সময়টিতে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা—আশ্রয়স্থল তৈরি, আগাম সতর্কতা জারি এবং ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো সুরক্ষিত করা। তবে, ভারত থেকে গেট খোলার আগে বাংলাদেশকে জানানো হয়নি, যা আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে না পারার কারণে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি করে। এই অজ্ঞতা কেবলমাত্র অবহেলা নয়, এটি আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ আইনেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ আইনে, বিশেষ করে ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের নন-নেভিগেশনাল ওয়াটারকোর্স বিষয়ক কনভেনশনে, উজান দেশগুলো একাধিক প্রধান নীতির দ্বারা বাধ্যবাধক। এতে রয়েছে ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার, উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না করার বাধ্যবাধকতা এবং প্রভাবিত দেশের আগাম সতর্কতা প্রদানের দায়িত্ব।
“কোন ক্ষতি না করা” নীতি আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ আইনের একটি প্রধান ভিত্তি, যা একটি উজান দেশকে সমস্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করে যাতে নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলিতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি না হয়। দম্বুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পানি ছাড়ার আগে বাংলাদেশকে জানানো না হওয়ার ফলে, ভারত এই নীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে: মানুষের প্রাণহানি, বাড়িঘর ধ্বংস, এবং জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে। এটি কেবলমাত্র অবহেলা নয়, এটি আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ আইনের বাধ্যবাধকতার সরাসরি লঙ্ঘন।
ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত ব্যবহারের নীতি নিশ্চিত করে যে সমস্ত উপকূলীয় দেশগুলির জন্য ন্যায্যভাবে পানিসম্পদের ভাগ পাওয়া উচিত। তবে, বাংলাদেশের সাথে সমন্বয় না করেই ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পানি ছাড়ার সিদ্ধান্ত এই নীতির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। সমান ব্যবস্থাপনার পরিবর্তে, ভারতের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের ওপর অন্যায় বোঝা চাপিয়েছে, যা মৌসুমি বৃষ্টির কারণে ইতিমধ্যেই কঠিন পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে।
জাতিসংঘের পানি প্রবাহ কনভেনশনের ১২ অনুচ্ছেদে, রাষ্ট্রগুলিকে তাদের পরিকল্পিত কার্যক্রম সম্পর্কে অন্য উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলিকে পূর্বেই অবহিত করতে বলা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে, ভারত টানা বৃষ্টিপাতের কারণে সম্ভাব্য বন্যার আশঙ্কা সম্পর্কে আগাম জানার সুযোগ পেয়েছিল এবং দম্বুর প্ল্যান্ট থেকে পানি ছাড়ার ঘটনাটি পূর্বাভাসযোগ্য ছিল। বাংলাদেশকে অবহিত না করার কারণে প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নষ্ট হয়েছে এবং এটি ছিল এই বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন।
ভারতের এই কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশ এই বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক ফোরামে যেমন আন্তর্জাতিক আদালত বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব এবং এটি ভবিষ্যতে ক্ষতির প্রতিরোধের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বাধ্যবাধকতার এই ব্যর্থতা বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা চ্যালেঞ্জহীন থাকতে পারে না।
ভারতকে দায়বদ্ধ করার মাধ্যমে, বাংলাদেশ এই আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোগুলোর গুরুত্বকে পুনর্ব্যক্ত করবে, যা নিশ্চিত করবে যে উজান দেশগুলো তাদের দায়িত্বগুলি গুরুত্বের সাথে নেবে। আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে ভারতের ক্রমাগত অবহেলার এই ধারা তুলে ধরা হবে, যা শুধু বাংলাদেশের নয়, অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথেও সংঘটিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নেপাল এবং পাকিস্তানও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, যেখানে ভারতের একতরফা কার্যক্রমগুলির কারণে নিম্নাঞ্চলীয় ক্ষতি হয়েছে, তবে পর্যাপ্ত পরামর্শ বা পূর্বসতর্কতা প্রদান করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক আইনে বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে যা বাংলাদেশের আইনগত পদক্ষেপ ও ক্ষতিপূরণের দাবিকে সমর্থন করে। ট্রেইল স্মেল্টার সালিশ (যুক্তরাষ্ট্র বনাম কানাডা) আন্তর্জাতিক আইনে একটি সুপরিচিত মামলা যেখানে সীমান্ত পেরিয়ে ক্ষতির কারণে কানাডাকে দায়বদ্ধ করা হয়েছিল। একইভাবে, গ্যাবচিকোভো-নাগিমারোস প্রকল্প (হাঙ্গেরি বনাম স্লোভাকিয়া) মামলাটি এই নীতি তুলে ধরে যে রাষ্ট্রগুলিকে তাদের জল প্রকল্পের প্রভাবগুলি নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলির উপর বিবেচনা করতে হবে। এই মামলাগুলি প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রগুলি তাদের ক্রিয়াকলাপের কারণে ক্ষতির জন্য দায়ী, এমনকি সেই ক্রিয়াকলাপগুলি তাদের নিজস্ব সীমানার মধ্যেই ঘটলেও তাদের পরিণতি সীমান্তের বাইরে হতে পারে।
পানি সংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ যুক্তি দিতে পারে যে ভারতের কার্যক্রমগুলি এই নীতিগুলির লঙ্ঘন করে তাদের ভূমি ও জনগণের জন্য ক্ষতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বন্যার কারণে সৃষ্ট ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা যেতে পারে, পাশাপাশি ভারতের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক নিয়মাবলী মেনে চলার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা উচিত।
বাংলাদেশের এই আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের ক্ষতি প্রতিরোধের জন্যও। ভারতের কার্যক্রমগুলি বারবার প্রমাণ করেছে যে তারা নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলির প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করছে না। তাই আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থা এই ধরনের সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হতে পারে।
ভারতের অব্যাহত অবহেলা, বিশেষত উজানের দেশ হিসেবে তাদের পানি ছাড়ার আগের সতর্কতা না দেওয়ার প্রবণতা, কেবল বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলির জন্যও বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। প্রতিবার যখন ভারত তাদের নিজস্ব প্রয়োজন মেটাতে পানি ছেড়ে দেয়, তখন এর প্রভাব বাংলাদেশের মতো নিম্নাঞ্চলীয় দেশগুলির ওপর পড়ে, যারা ইতিমধ্যে বন্যার সাথে লড়াই করছে। বাংলাদেশ এর ফলস্বরূপ মানুষ, সম্পদ, এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে, যা উন্নয়ন প্রচেষ্টার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলছে।
অতীতের ঘটনা এবং বর্তমান পরিস্থিতির ভিত্তিতে, এখন সময় এসেছে ভারতকে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে দায়বদ্ধ করার। এটি শুধু ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয় নয়, বরং একটি ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থার প্রয়োজন। আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি বার্তা পাঠানো হবে যে পানিসম্পদ ব্যবহার করার সময় দায়িত্বশীলতা এবং সতর্কতা মেনে চলা জরুরি।
ভারত যদি বারবার বাংলাদেশের স্বার্থকে অবহেলা করে তার জলসম্পদ ব্যবস্থাপনায় unilateral সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তবে সেই কাজ আন্তর্জাতিক আইনের নীতি লঙ্ঘন করেছে, বিশেষ করে ক্ষতি না করার নীতির প্রতি। বাংলাদেশকে উজানের দেশ হিসেবে ভারতের বাধ্যবাধকতাগুলির প্রতি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্পষ্ট দাবি তুলতে হবে এবং তা কেবল নিজেদের সুরক্ষা নয়, সমগ্র অঞ্চলজুড়ে পানি ব্যবস্থাপনায় ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই সমাধান নিশ্চিত করার জন্যও।
এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত দেবে, বিশেষ করে যখন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাদের সহনশীলতা সীমাবদ্ধ হয়ে আসছে। প্রকৃতি এবং মানবসৃষ্ট এই ধ্বংসাত্মক বন্যাগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার সময়, বাংলাদেশকে শুধু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাই নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে একটি সুরক্ষামূলক নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা তাদের জনগণকে ভবিষ্যতে এই ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে।