এশিয়া কাপের শেষটা জয় দিয়ে রাঙিয়েছে বাংলাদেশ দল। এই জয় না পেলে হয়তো টাইগারদের এশিয়া কাপ মিশন ‘ব্যর্থতায়’ পরিপূর্ণ হতো। যাহোক সুপার ফোরে টানা দুই ম্যাচ হেরে নিজেদের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারতকে হারিয়েছে টাইগাররা।
শুক্রবার কলম্বোর আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ভারতের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। যেখানে টিম ইন্ডিয়াকে ৬ রানে হারিয়েছে টাইগাররা। এমন জয়ে এশিয়া কাপের মঞ্চে ভারতকে ১১ বছর পর হারালেন সাকিব-মুস্তাফিজরা। একই সঙ্গে পাকিস্তানকে হটিয়ে পয়েন্ট টেবিলের তিনে থেকে টুর্নামেন্ট শেষ করেছে চন্ডিকা হাথুরুসিংহের শিষ্যরা।
কোন মন্ত্রে টুর্নামেন্টের অপরাজিত ভারতকে হারালো বাংলাদেশ দল। ডেইলি বাংলাদেশের এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভারতের বিপক্ষে টাইগারদের সফল হওয়ার কৌশলগুলো।
এবারের এশিয়া কাপে প্রথম দল হিসেবে ফাইনাল নিশ্চিত করে ভারত। ফলে বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটি তাদের জন্য ছিল অনেকটাই ‘গুরুত্বহীন’। অন্যদিকে, টাইগারদের জয়-পরাজয়ও ফাইনালের সমীকরণে কোনো প্রভাব ফেলতো না। যে কারণে এ ম্যাচটি টাইগারদের জন্যও ছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতার।
এদিকে গেল কয়েকদিন ধরেই ভারতীয় ক্রিকেটারদের বিশ্রামের কথা শোনা যাচ্ছিল। গুরুত্বহীন ম্যাচে বিরাট কোহলি, মোহাম্মদ সিরাজ ও জাসপ্রিত বুমরাহদের বিশ্রামে রাখা হয়। তাদের পরিবর্তে দলে সুযোগ পান তিলক ভার্মা ও মোহাম্মদ শামিরা। তুলনামূলক কম শক্তিশালী দলের বিপক্ষে জয় তুলে নেয়ার সুযোগ ছিল টাইগারদের সামনে। যা পুরোপুরি আদায় করে নিয়েছেন সাকিব-মুস্তাফিজরা।
শুধু ভারতই নয়, এ ম্যাচে সেরা একাদশে পাঁচ পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নামে বাংলাদেশ। যেখানে অভিষেক হয় তানজিম হাসান সাকিবের। আর দলে ফিরেন মুস্তাফিজ, বিজয়, তামিম ও শেখ মাহেদী। শক্তিমত্তার বিচারে ভারতের চেয়ে টাইগার স্কোয়াড ‘দুর্বল’ ছিল। তবে সাহসী সিদ্ধান্তেই বাজিমাত করেছেন সাকিব ও হাথুরুসিংহে।
ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয় তানজিম হাসান সাকিবের। একই সঙ্গে দলে ফেরেন আরো চার ক্রিকেটার। ছবি- ক্রিকইনফো
ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয় তানজিম হাসান সাকিবের। একই সঙ্গে দলে ফেরেন আরো চার ক্রিকেটার।
এদিন অভিষিক্ত সাকিব এবং দলে ফেরা মুস্তাফিজ ও মাহেদী দ্যুতি ছড়িয়েছেন। ফলে টিম ইন্ডিয়ার বিপক্ষে জয় বাগিয়ে নিয়েছে লাল-সবুজের জার্সিধারীরা।
দেওয়ালে পিঠ না ঠেকলেই নাকি জ্বলে ওঠেন সাকিব আল হাসান। হয়তো তাই-ই, সেটি না হলে ভারতের বিপক্ষে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেছিলেন কেন?
শুক্রবার কলম্বোতে আগে ব্যাট করতে ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এদিন চার নম্বরে ব্যাট করতে আসেন সাকিব। এরপর একে একে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন এনামুল হক বিজয় ও মেহেদী মিরাজ। দলের ব্যাটিং বিপর্যয়ে জ্বলে ওঠেন টাইগার দলপতি।
উইকেটে থিতু হয়েই ভারতের বোলারদের ওপর চড়াও হন সাকিব। এ ম্যাচে সবমিলিয়ে ১২১ মিনিট উইকেটে ছিলেন তিনি। যেখানে ৮৫ বলে ৮০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন। ছয় বাউন্ডারি ও ৩ ছক্কায় সাজানো ছিল তার ইনিংসটি।
ব্যাটিংয়ের পর বল হাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাকিব। ১০ ওভার বল করে সাড়ে ৪ ইকোনোমিতে ৪৩ রান খরচ করেন তিনি। পাশাপাশি ভারতের ভয়ংকর ব্যাটার সূর্যকুমার যাদবের উইকেট শিকার করেন। এতে জয়ের রাতে ম্যাচসেরার পুরস্কারও উঠেছে তার হাতেই।
ভারতের বিপক্ষে ৫৯ রানে চার উইকেট হারিয়ে রীতিমতো ধুঁকছিল বাংলাদেশ দল। এমন সময় বাইশ গজে আসেন তাওহীদ হৃদয়। নিজেকে উইকেটে মানিয়ে নিতে সময় নিলেও অর্ধ শতক তুলে নেন। এতে টাইগাররা অনেকটাই ব্যাটিং বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠে। ফিফটির ইনিংস লম্বা করতে পারেননি ঠিকই, তবে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের হাল ধরে লড়াই করেছেন এ উঠতি তারকা।
ব্যাট হাতে টেল এন্ডারে জ্বলে ওঠা টাইগারদের জন্য রীতিমতো বিস্ময়কর! ভারতের বিপক্ষে টপ অর্ডার যখন ব্যর্থ, তখন ব্যাট হাতে দায়িত্ব তুলে নেন টেল এন্ডাররা। নিয়ম রক্ষার ম্যাচ হলেও এক চুলও ছাড় দিতে নারাজ নাসুম-মাহেদীরা।
তাওহীদ হৃদয় যখন তিলক ভার্মাকে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরছিলেন, তখন টাইগারদের স্কোর ১৯৩ রানে ৭ উইকেট। সে সময় অনেকেই ভেবেছিলেন, হয়তো আর ২০-২৫ রান তুলতেই সব উইকেট হারিয়ে ফেলবে টাইগাররা। কিন্তু সেই ভাবনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে শেষ ৫২ বলে ৭২ রান তোলেন নাসুম-মাহেদীরা। তাতে টাইগারদের ইনিংস থামে ২৬৫ রানে।
এদিন ব্যাট হাতে ক্যারিয়ার সেরা ৪৪ রানের ইনিংস খেলেন নাসুম আহমেদ। পাশাপাশি দলের হাল ধরে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে ২৯ রানে অপরাজিত থাকেন শেখ মাহেদী। অন্যদিকে, এক ছক্কা ও বাউন্ডারিতে ১৪ রান তোলে অভিষিক্ত সাকিব। টেল এন্ডারে এই তিন ব্যাটারের ক্যামিও ইনিংসে চ্যালেঞ্জিং সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ।
ভারতের বিপক্ষে টাইগারদের জার্সিতে অভিষেক হয় উঠতি পেসার তানজিম হাসান সাকিবের। অভিষেক ম্যাচেই বল হাতে দ্যুতি ছড়িয়েছেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপজয়ী এ ক্রিকেটার।
নিজের অভিষেক ম্যাচের প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মার উইকেট শিকার করেন সাকিব। ম্যাচের তৃতীয় ও নিজের দ্বিতীয় ওভারে দুর্দান্ত স্পেলে ভারতের অভিষিক্ত তিলক ভার্মাকে বোল্ড করেন তিনি। এরপর গোটা ম্যাচেই কিপটে বোলিং করে ৭.৫ ওভারে ৩২ রান খরচ করেছেন এ ডানহাতি পেসার।
মুস্তাফিজুর রহমানকে ভাবা হতো ‘অটোচয়েজ’। কিন্তু এবারের এশিয়া কাপের অধিকাংশ ম্যাচই বেঞ্চ গরম করেছেন তিনি। ছয় জাতির টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে মাঠে নামে বাংলাদেশ। যেখানে মাত্র ৩ ওভার বল করার সুযোগ পেয়েছিলেন ফিজ। তাতে বেশ ইকোনোমিকাল ছিলেন তিনি। ৩ ওভার হাত ঘুরিয়ে খরচ করেন ১২ রান। কিন্তু দলের হারে কপাল পোড়ে তার!
এরপর টানা তিন ম্যাচ একাদশের বাইরে ছিলেন মুস্তাফিজুর। অবশেষে নিয়ম রক্ষার ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে দলে ফিরেন তিনি। আর তাতেই বাজিমাত করেছেন কাটার মাস্টার।
টুর্নামেন্টের অপারিজত ভারতের তিন ব্যাটারকে সাজঘরের পথ দেখিয়েছেন ফিজ। এদিন ৮ ওভারে ২৪ বল ডট দিয়ে ৫০ রান দেন তিনি। বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিন উইকেট শিকার করেন। বল হাতে একে একে রবীন্দ্র জাদেজা, অক্সার প্যাটেল ও শার্দুল ঠাকুরের উইকেট তুলে নিয়েছেন এ বাঁ-হাতি পেসার।
চলতি বছরের শুরুতে টাইগার কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, ‘ব্র্যান্ড ক্রিকেট’ খেলতে চায় তারা। যার মানে ক্রিকেটের তিন ইউনিট ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করা। হোম এবং অ্যাওয়ে সিরিজে সেটি প্রদর্শন হলেও মাঝখানে খেই হারিয়ে ফেলেছিল টাইগাররা।
শুক্রবার এশিয়া কাপের নিয়ম রক্ষার ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ব্যাটিং, বোলিংয়ের পাশাপাশি ফিল্ডিংয়েও হার না মানা মনোভাব দেখা গেছে টাইগারদের শরীরী ভাষায়।
এদিন ম্যাচের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এক চুলও ছাড় দিতে চাননি টাইগাররা। যার ফলশ্রুতিতে শর্ট মিডউইকেটে শামীম হোসেন, লং অফে হৃদয় ও তানজিদের দুর্দান্ত ক্যাচ ম্যাচের চেহারা বদলে দিয়েছিল। এই তিনটি ক্যাচই ছিল যথাক্রমে লোকেশ রাহুল, শুভমান গিল ও অক্সার প্যাটেলের। আর শেষ মুহূর্তে তানজিদের দ্রুতগতির থ্রোতে লিটনের রান আউটের দৃশ্য। এককথায় বলতে গেলে এসব দৃশ্য ছিল যেন ‘স্ক্রিপ্টেড’।